হাওজা নিউজ এজেন্সি: প্রথমবার আরবাঈন পদযাত্রার কথা শোনার পরই মানুষের বিস্ময় জাগে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দেখে—সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যা দাঁড়িয়েছে দুই কোটি থেকে আড়াই কোটিরও বেশি। সবার একটিই লক্ষ্য—কারবালায় পৌঁছে ইমাম হুসাইন (আ.) ও অন্যান্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। তবে শুধু গন্তব্য নয়, বরং পদযাত্রা ও অংশগ্রহণকারীদের আচরণ মানবজীবনের জন্য গভীর শিক্ষা বহন করে।
পদযাত্রীদের বৈচিত্র্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষ; বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও দেশের নাগরিক; কেউ তরুণ ও সুস্থ, কেউ ক্রাচে ভর দিয়ে, লাঠি হাতে বা হুইলচেয়ারে। এক অদম্য সংকল্প তাদের একত্র করেছে। শিয়া মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্যেও রয়েছেন অনেক সুন্নি, এমনকি খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। কেউ কেউ আবার কোনো ধর্ম মানেন না, তবুও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মানবিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। এই বৈচিত্র্য মনে করিয়ে দেয়—আমরা সবাই আদম সন্তান, সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত ফিতরতের দীন-এর অনুসারী হওয়ার আহ্বানপ্রাপ্ত। আরবাঈনে অংশ নেওয়া মানে বিভাজনের দেয়াল ভেঙে স্রষ্টার সামনে মানবজাতির ঐক্যের বাস্তব অনুভূতিতে ফিরে আসা।
আজকের বস্তুবাদী দুনিয়ায় প্রচলিত স্বার্থকেন্দ্রিক ধারণা—অন্যকে শোষণ করে সম্পদ অর্জন, শক্তি ও অর্থের গর্ব, কিংবা ঈশ্বর কেবল আমাদের পক্ষেই আছেন—এসবকে আরবাঈন পদযাত্রা পাল্টে দেয়। এখানে স্বল্পসম্পদ মানুষ তাদের সবটুকু বিলিয়ে দেয় ধনী অতিথিদের জন্য। কেউ বিশুদ্ধ পানি কিনে এনে বিনামূল্যে পথচারীদের পান করায়; কেউ দক্ষতা—যেমন চিকিৎসা, মেরামত বা রান্না—নিঃশুল্কভাবে সবার সেবায় ব্যয় করে। এই বাস্তবতা আমাদের ভাবায়—ধনীরা কি সব ভালো জিনিসই ভোগ করবে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ন্যূনতম জীবিকার জন্য সংগ্রাম করবে? আমার প্রাপ্ত শিক্ষা ও দক্ষতা কি কেবল অর্থবানদের সেবায় ব্যয় হবে?
পৃথিবী আজ এমন এক ব্যবস্থায় আবদ্ধ, যেখানে সম্পদ প্রায়শই অন্যকে শোষণ করে অর্জিত হয়। আরবাঈনের মূল্যবোধ আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—আজকের যুগের স্বৈরশাসক কারা, আর আধুনিক নিপীড়নের রূপ কী? ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসা কেবল আধ্যাত্মিক চিন্তনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা বিশ্বজুড়ে ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার কর্মে রূপ নিতে হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যে “অন্তিম সময়”-এর ধারণা আছে—যখন মসীহ বা ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হয়ে মানবজাতিকে স্রষ্টার প্রদত্ত জীবনব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন। তখন শোষণ, স্বৈরাচার ও অন্যায় বিলীন হবে; সম্পদ ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ হবে; ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে; বৈচিত্র্যের মাঝে মানবজাতি হবে ঐক্যবদ্ধ পরিবার।
এই চিত্র কি আমাদের হৃদয়ে আকর্ষণ জাগায় না? আরবাঈন পদযাত্রা সেই ভবিষ্যতের জীবনের আভাস দেয়—যেখানে ন্যায়, সাম্য ও শান্তি মানুষের জীবনের ভিত্তি। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি আজকের মতোই জীবন কাটিয়ে দেব, কেবল আশা করব “একদিন ইমাম মাহদী আসবেন, তখন সব ঠিক হবে”?
ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের শাহাদাত, হজরত জয়নাব (সা.আ.) অদম্য সাহস এবং সত্যের পক্ষে তাঁর অকুতোভয় উচ্চারণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—এখনই সময় জেগে ওঠার, নিজের অবস্থান উপলব্ধি করার এবং সেই ন্যায় ও শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার, যা আমরা অন্তিম সময়ে প্রত্যাশা করি।
—ড. ক্রিস হিউয়ার খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব, শিক্ষা, ইসলামি শিক্ষা ও আন্তঃধর্ম অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞ। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি ব্রিটেনে মুসলমান ও খ্রিস্টান-মুসলিম সম্পর্ক বিষয়ে কাজ করছেন।
আপনার কমেন্ট